মানবিক মহিউদ্দিন চৌধুরী - ড. মুহম্মদ মাসুম চৌধুরী।
ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জহুরলাল নেহেরু বলতেন, দুই ধরনের নেতা আছে, লিডার অব পার্টি আর লিডার অব পিপলস্। মহিউদ্দিন চৌধুরী ছিলেন প্রকৃত একজন জননেতা, জনগণের নেতা।
আমার জীবনের সেরা একটি অর্জন আমি বিশাল মনের মানবিক এক নেতা আলহাজ্ব এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর কর্মী ছিলাম। যে নেতার মানবিক গুণ সবাইকে আকর্ষণ করতো। এ ধরনের নেতার সাথে রাজনীতি করা গৌরবের। আমার এই নেতা কত দরিদ্র সন্তানের পড়াশোনার খরচ যোগাতেন, কত গরিব মেয়ের বিয়ে নিজ খরচে, নিজ হাতে অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতেন তার নেই ইয়ত্তা। তিনি সমাজের নিম্নস্তরের মানুষকে যথাযথ সম্মান দিতেন। মেথরকে সম্মানিত করতে তাদের নাম দিলেন ‘সেবক’। তাদের জন্য বিল্ডিং নির্মাণ করে নাম রাখেন ‘সেবক কলোনী’। তিনি সেবকদের ছেলে মেয়েদের বিয়ের সরঞ্জাম নিজ টাকায় ক্রয় করে দিতেন। আমি কোন নেতাকে সেবকদের অনুষ্ঠানে বসে তাদের সাথে খেতে দেখিনি। মহিউদ্দিন চৌধুরী সেবকদের সাথে বসে এক সাথে খেতেন এবং নবদম্পতির মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করতেন। তাঁর বাসায় ছিল সেবকদের অবাধ প্রবেশাধিকার।
চশমা হিলের বাসায় সেবকরা গেলে তিনি তাদের বলতেন, অ খা আইয়ু বইও। সাথে সাথে তাদের চা নাস্তা দিতে নির্দেশ দিতেন। মহিউদ্দিন ভাইয়ের আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়ে তারা তাঁকে দেবতার আসনে অধিষ্ঠিত করেছিলেন। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে বাঁশখালী হতে পতেঙ্গা উপকূলীয় অঞ্চলে হাজার হাজার মানুষের মৃতদেহ স্তূপে পরিণত হয়। এ সব অজানা অচেনা গলিত দুর্গন্ধযুক্ত লাশ কাঁধে বহন করে নিজ হাতে দাফন করেন। এই ধরনের কাজ কোন নেতা করতে আমি জীবনে দেখিনি। এসময় উপকূলের প্রচুর লোক ডায়রিয়াসহ নানা রোগে আক্রান্ত হন। তাদের জন্য তিনি মুসলিম হলে ক্যাম্প হাসপাতাল ও নঙ্গলখানা খুলেছিলেন। এ সব কর্মের মাধ্যমে তিনি চট্টগ্রামের মানবিক এক মহাননেতার আসনে অধিষ্ঠিত হন।
তুচ্ছ একটি ঘটনা নিয়ে ১৯৯৩ সালের প্রথম দিকে বন্দর এলাকায় নৌবাহিনী সদস্যদের সাথে স্থানীয় জনগণের সংঘাত হয়। এই ঘটনায় স্থানীয় কয়েকজন লোক মারা যায়। সংঘাতস্থলে সাহস নিয়ে তৎকালীন সরকারের কোন মন্ত্রী মেয়র যেতে সাহস না করলেও মহিউদ্দিন চৌধুরী বুকে সাহস নিয়ে এগিয়ে যান। মৃত লাশের গোসল ও দাফন কাফন নিজ হাতে করেন। তিনি এভাবে অনেক বেওয়ারিশ লাশের দাফন কাফন করতে দেখছি।
একইভাবে কালুরঘাট গার্মেন্টসে অগ্নিদগ্ধ অর্ধ শতাধিক শ্রমিকের লাশের দাফন কাফন করেন।
বাংলাদেশ প্রথম বেসরকারি হজ্ব কাফেলা ‘মেয়র হজ্ব কাফেলা’ ছিল বাংলাদেশে ব্যতিক্রম ধর্মী একটি প্রতিষ্ঠান। তাঁর প্রতিষ্ঠিত এই কাফেলায় তিনি হাজীদের নিজ হাতে গোসল করানো, কাপড়চোপড় ধোয়া, মলমূত্র পরিষ্কার এবং কোরবানীর পর হাজীদের মাথা মুন্ডন ছিল তাঁর ধর্মীয় মানবিক কাজ। তাঁর এসব মানবিক কাজের কারণে প্রতিটা হাজী এক এক জন তাঁর ভক্তে পরিণত হয়। তাঁর অনেক সমালোচক মেয়র হজ্ব কাফেলায় হজ্ব সম্পন্ন করে দেশে ফিরে এসে প্রশংসায় পঞ্চমুখ দেখেছি। তারা বলতেন, ‘যে যা বলুক, মহিউদ্দিন চৌধুরীকে মহান আল্লাহ পাক কবুল করেছেন।কারাজীবনের সাথীরা ছিল তাঁর চির বন্ধু। কারণ কারাগারে তিনি পরিচিত অপরিচিত সব দল ও মতের মানুষের সেবা করতেন। যেকোন পরিবেশে মানুষকে আপন করে নেওয়ার ক্ষমতা ছিল তাঁর অসাধারণ। শোষিত নির্যাতিত বঞ্চিত মানুষের প্রতি মহিউদ্দিন চৌধুরীর ছিল অসম্ভব অনুরাগ। তাদের সেবা করা ছিল তাঁর ধ্যান জ্ঞান। এসব গুণাবলীর কারণে তিনি রাজনৈতিক নেতার সীমানা পেরিয়ে এক মানবিক নেতায় পরিণত হয়ে ছিলেন।
এক শীতের রাতে একজন বৃদ্ধ মানুষ কাঁধে হ্যাঙ্গর নিয়ে রাস্তায় বিক্রি করছে। প্রচন্ড শীতে এই বৃদ্ধের কষ্ট দেখে গাড়ি হতে তিনি নেমে সব হাঙ্গর ক্রয় করে লোকটিকে ঘরে চলে যেতে বলেন। ঈদের সময় রাস্তা হতে ভিক্ষুক গাড়িতে তুলে ঘরে এনে নিজ হাতে নতুন জামাকাপড় পরিয়ে আপ্যায়িত করতেন। এতিমদের নিজ হাতে খাবার পরিবেশন করা ছিল তাঁর আনন্দ।
বস্তিবাসী ছেলে মেয়েদের ১৩/১৪ বছর হওয়ার পরও টাকার অভাবে খতনা ও মেয়েদের কানছেদন করা সম্ভব হতো না। কারণ ৩/৪ হাজার টাকা খরচ করা বস্তিবাসীর পক্ষে সম্ভব ছিল না। মহিউদ্দিন চৌধুরী বস্তির সন্তানদের জন্য ফ্রি খতনা ও কানছেদনের ব্যবস্থা করেছিলেন। এই ধরনের মানবিক কাজ বাংলাদেশের কোন স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান করেনি।
ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জহুরলাল নেহেরু বলতেন, দুই ধরনের নেতা আছে, লিডার অব পার্টি আর লিডার অব পিপলস্। মহিউদ্দিন চৌধুরী ছিলেন প্রকৃত একজন জননেতা, জনগণের নেতা।
শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা সিটি কর্পোরেশনের কাজ নয়, তিনি অসহায় মানুষের শিক্ষা স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে প্রায় ৬০টি স্কুল এবং কলেজ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের অধীনে পরিচালনা করতেন। অথচ পুরো দেশের সব সিটি কর্পোরেশনগুলোর পরিচালনাধীন ৫০টি স্কুল এবং কলেজ ছিল না। সাধারণ মানুষের কল্যাণার্থে কয়েকটি মাতৃসদন হাসপাতালসহ প্রতি ওয়ার্ডে একটি করে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স চালু করেছিলেন। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মাধ্যমে ৪৫০টি ফোরকানিয়া মাদ্রাসা পরিচালনা করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। বাংলাদেশে তিনি প্রথম লাশের এসি গাড়ি, এসি পাবলিক টয়লেট চালু করেন। ১৭ বছর এক টাকাও টেক্স না বাড়িয়ে নগরীর ব্যাপক উন্নয়ন করা মিরাকল।
মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যার দস্তরখানা যত বড়, তিনি মানুষ হিসেবে তত বড়। মহিউদ্দিন চৌধুরীর দস্তরখানা ছিল অনেক বড়। তিনি প্রতিদিন শত শত মানুষকে খাওয়াতেন। তাঁর ঘর হতে কেউ না খেয়ে আসতে পারতেন না। একদিন চশমাহিলস্থ তাঁর বাসা হতে এক ছেলে জুতা চুরি করে নিয়ে যাওয়ার সময় দারোয়ানের হাতে ধরা পড়ে যায়। চোরকে মহিউদ্দিন চৌধুরীর হাতে অর্পণ করলে তিনি চোরকে বেঁধে মারার এবং জেলে দেওয়ার ভয় দেখায়। হঠাৎ কথার মাঝে বলে বসেন,‘ আগে আমার ঘরে ভাত খেয়ে নেয়, তারপর তোর বিচার’। এই হলো আমার নেতা মহিউদ্দিন চৌধুরী।
প্রকৃতপক্ষে সাবেক মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী বহুমাত্রিক এক নেতার নাম। এমন নেতা পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের বিষয়। তিনি চট্টগ্রামের কিংবদন্তী। তাঁর তুলনা তিনি ছাড়া আর কেউ নেই।
শত শত মানবিক কাজের কারণে তাঁর মৃত্যুতে সুইপার, হকার, রিক্সাওয়ালা, সিএনজি চালক, ভিক্ষুকসহ হাজার হাজার গরিব দুঃখী মানুষ কান্না করতে দেখছি। এই কান্না মহিউদ্দিন ভাইয়ের জন্য। অন্য কোন নেতার ভাগ্যে জুটবে না এই সম্মান।
ড. মুহম্মদ মাসুম চৌধুরী
লেখক : কলাম লেখক ও রাজনীতিক
No comments