বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল জলিল
![]() |
আব্দুল জলিল |
আব্দুল জলিল সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন
জন্ম
২১ জানুয়ারি ১৯৩৯ আব্দুল জলিল ১৯৩৯ সালের ২১ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন নওগাঁ জেলার সদর উপজেলার চকপ্রাণ গ্রামে। তার বাবার নাম ফয়েজউদ্দিন আহমেদ এবং মাতার নাম জারিনা ফায়েজ।বাবা ফয়েজউদ্দিন আহমেদ ছিলেন ব্যবসায়ী।
ব্যক্তিগত জীবন ও শিক্ষা
আব্দুল জলিল স্থানীয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তার শিক্ষা জীবনের শুরু। স্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেই তিনি মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। তিনি নওগাঁ কে. ডি. সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৫৭ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। সেখানে পড়াশুনা শেষে ভর্তি হন রাজশাহী কলেজে। সেখানে তিনি উচ্চ মাধ্যমিক পড়াশোনা সম্পন্ন করেন। ১৯৬০ সালে আব্দুল জলিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এরপর ১৯৬৩ সালে তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক (সম্মান) সম্পন্ন করেন এবং ১৯৬৪ সালে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। এরপর তিনি আইন বিষয়ে পড়াশুনা করার জন্য লন্ডনে যান। কিন্তু, পড়াশুনা শেষ না করেই ১৯৬৯ সালে তাকে দেশে ফিরে আসতে হয়।
রাজনৈতিক জীবন
তার রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় ১৯৫০-এর দশকের শেষ ভাগে। ছাত্রজীবনেই তিনি তৎকালীন বিভিন্ন আন্দোলন অংশগ্রহণ করতে শুরু করেন। তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর। তার অন্যতম পরিচয় ছিল ‘নওগাঁর জলিল’ হিসাবে। আব্দুল জলিল ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ৭ নং সেক্টরের প্রধান সংগঠক ও যোদ্ধা ছিলেন। ১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে তৎকালীন রাজশাহী-৮ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি, বাকশাল গঠিত হলে তাকে নওগাঁর গভর্নরের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের পর তাকে গ্রেফতার করা হয়। ৪ বছর পর ১৯৭৯ সালে তিনি মুক্তিলাভ করেন।
১৯৮১ সালে তাকে আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক করা হয়। ১৯৮২ সালে সামরিক শ্বাসন জারি করা হলে তাকে পুনরায় গ্রেফতার করা হয়। ১৯৮৩ সালে তাকে আওয়ামী লীগের যুগ্ন সাধরন সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৯৮৪ এবং ১৯৮৮ সালে তিনি পরপর দু’বার নওগাঁ পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৮৬ সালে তিনি দ্বিতীয়বারের মত নওগাঁ সদর আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং সংসদে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮০’র দশকে তিনি স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সে সময় থেকেই বিবিসি রেডিও এবং ভয়েজ অব আমেরিকায় নিয়মিতভাবে আওয়ামী লীগের মুখপাত্র হিসেবে তার কণ্ঠস্বর শোনা যেত।
১৯৯৩ সালে তাঁকে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য করা হয়। ২০০২ সাল পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হলে ১৯৯৮ সালে তাঁকে টেকনোক্র্যাট কোটায় বাণিজ্য মন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। ২০০১ এবং ২০০৮ এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নওগাঁ সদর আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০২ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ছিলেন উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য।
মুক্তিযুদ্ধে অবদান
দেশে যখন স্বাধীনতার সংগ্রাম জোরদার হতে থাকে তখন আব্দুল জলিল লন্ডনে ছিলেন। ১৯৬৯ সালে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনের সময় তিনি থেকে দেশে ফিরে আসেন। সে সময় তিনি লন্ডনের লিঁঙ্কনস ইন-এ আইন বিষয়ে পড়াশুনা করছিলেন। আব্দুল জলিল সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালের মার্চে বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের ডাক দিলে তিনি নওগাঁ তথা উত্তরাঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের একীভূত করতে শুরু করেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রথম দিকে আব্দুল জলিল নওগাঁ থেকে ৭৪ জন মুক্তিযোদ্ধা ও তার দলবল নিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে চলে যান এবং বালুরঘাটে আত্রাই নদীর পূর্বতীরে শ্মশানকালী মন্দিরের পার্শ্বে একটি গৃহে অবস্থান গ্রহণ করেন। সেখান থেকে বাঙ্গালীপুর, মধুপুর, কামাড়পাড়া, প্যারিলাসহ ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকায় বেশ কয়েকটি ট্রেনিং ক্যাম্প পরিচালনা করেন।
ঐসব ক্যাম্প থেকে হায়ার ট্রেনিং এর জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের শিলিগুড়ির পানিঘাটায় পাঠিয়ে দেওয়ার বিশাল দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি। নওগাঁ, জয়পুরহাট, দিনাজপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ ও পাবনার অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল জলিলের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এসব ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। যুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাকে উত্তরাঞ্চলের জেনারেল হিসাবে অ্যাখ্যায়িত করেন। নওগাঁ শহরের উত্তর-পশ্চিম পার্শ্বে আব্দুল জলিল চত্বরে তার প্রচেষ্টার নির্মিত হয় বিজয় মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভ। ৭১ ফুট উঁচু এই স্মৃতিস্তম্ভ ১৯৭১-এর স্মৃতি বহন করে।
মৃত্যু
দীর্ঘ দিন যাবৎ তিনি কিডনির সমস্যায় ও হৃদরোগে ভুগছিলেন। তার হৃৎপিণ্ডের তিন-তিনবার বাইপাস সার্জারি হয়েছিল। ২০১৩ খ্রীস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে নওগাঁয় অবস্থানকালে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁকে ঢাকায় নেয়া হলে তিনি কিছুটা সুস্থ হন। ২৬ ফেব্রুয়ারি উন্নততর চিকিৎসার লক্ষ্যে তাকে সিঙ্গাপুরে মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে নেওয়া হয়। ৪ মার্চ সোমবার তার হৃৎপিণ্ডে পুনর্বার অস্ত্রোপচার করা হয়, কিন্তু তিনি অস্ত্রোপচার করাতে চাচ্ছিলেন না। পাঁচ ঘণ্টা স্বায়ী অস্ত্রোপচার সফল হয়।
তিনি জ্ঞান ফিরে কথা বলেছিলেন। কিন্তু বৃক্কে ডায়ালাইসিসজনিত জটিলতায় ৬ মার্চ ভোর থেকে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। তিনি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন। একপর্যায়ে কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস দেয়া হয়। ঐ দিন সন্ধ্যায় বাংলাদেশ সময় সাড়ে ছয়টায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এসময় তার বয়স হয়েছিল ৭৪ বৎসর। তাকে তার নিজ বাসভবন নওগাঁ জেলার সদর থানার চকপ্রান গ্রামে দাফন করা হয়।
No comments