কিংবদন্তির বুকে নোনা হ্রদ
চট্টগ্রামের মানুষ পিতাহারা সন্তানের মতো এখনো তার চশমা পাহাড়ের কবরে পিপড়ার সারি বেঁধে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে।
মঙ্গলবার , ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৭ একটা হাত আমার উরুর উপর রাখা। অঝোর কান্নার স্রোত ভাঙছে দু’চোখে। জিপের সামনের আসনে চালকের পাশে তার এপিএস ওসমান গনি। নেতার পাশে আমি।
চট্টগ্রামের মানুষ পিতাহারা সন্তানের মতো এখনো তার চশমা পাহাড়ের কবরে পিপড়ার সারি বেঁধে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে।
সাধারণত জিপে তিনি যাত্রী আসনে তিনজনকে তুলে নেন। বামপাশে বসেন, অন্যরা চিপাচিপি করে বসতেন। মোটা কেউ থাকলে খুবই সমস্যা হতো। চিপাচিপির মাঝে যতবার বসতে হয়েছে–ততবারই তার পাশে থাকতে হয়েছে।
তিনি ভালভাবে বসতে বলতেন, নিজকে আরো সরিয়ে নিয়ে জায়গা করে দেয়ার চেষ্টা করতেন। তিনি অসুস্থ। ভালভাবে হাঁটতেও পারেন না। অস্বস্তির কারণে যতটুকু সম্ভব, গুটিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেও পারতাম না। উরুতে হাত রেখে আরো কাছে টেনে নিতেন। এদিন আর কাউকে নেননি।
যাচ্ছেন, চান্দগাঁও এলাকার একটি মেজবানী অনুষ্ঠানে। সম্ভবত রাত সাড়ে আটটা। কথায় কথায় তিনি প্রিয় কন্যা প্রয়াত টুম্পার কথা তোলেন। মেয়ের স্মৃতিচারণ করতে করতে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। কোনভাবেই তাঁকে সামলানো যাচ্ছে না।
চট্টগ্রামের সিংহ পুরুষটির ভেতরে এতবড় একটা কান্নার নোনা হ্রদ লুকিয়ে ছিল, তা আগে কখনো আবিষ্কার করা হয়নি। দুর্ভাগ্য আমার, টুম্পার অকাল প্রয়াণের পর আজাদীর আজমিশালীতে ‘মাটির সীমানা– টুম্পার ঠিকানা’ শিরোনামে নিয়মিত কলামে একটা লেখা বের হয় ২০০৮ সালে, টুম্পার মৃত্যুর পর। পিতৃ আবেগ উজাড় করে বোধ হয় লেখাটা তৈরি করি।
তখনো অসুস্থ তিনি। এমনিতে আমি নিরাপদ দূরত্বে থাকতাম। তাঁকে এড়িয়ে চলি। কিন্তু লেখাটি প্রকাশের পর দূরে থাকা সম্ভব হয়নি। এক রকম বাধ্য হয়ে আবারো তাঁর কাছাকাছি আসতে হয়। টুম্পাকে নিয়ে স্মরণ সভা আয়োজন, স্মারকগ্রন্থ প্রকাশনাসহ সব দায়িত্ব জোর করে দুর্বল কাঁধে চাপিয়ে দেয়া হয়। টুম্পা স্মরণ পরিষদের চেয়ারম্যান করা হয় সর্বজন শ্রদ্ধেয় কৃতী ভৌতবিজ্ঞানী প্রয়াত ড. জামাল নজরুল ইসলামকে। সদস্য সচিবের দায়িত্ব চাপে নিজের কাঁধে। নেতা তখন সিটি মেয়র।
পারিবারিক উদ্যোগে টুম্পার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে স্মরণ সভা ও পরদিন একই ভেন্যুতে বড় জেয়াফতের আয়োজন করেন। অনুষ্ঠানের একদিন আগে টুম্পা স্মারক গ্রন্থ প্রকাশিত হয় বাংলা–ইংরেজি দু’ভাষায়। গ্রন্থটির প্রকাশনা, সম্পাদনা, লেখা সংগ্রহসহ সব দায়িত্ব একাই সামলাতে হয়। প্রচণ্ড চাপের মধ্যে কাজটি করতে হয়েছে।
টুম্পার ছোট্ট জীবন বই আকারে তুলে ধরতে অনেক তথ্য উপাত্ত যোগাড় করতে হয়েছে। কাজটি এত বেশি নাজুক এবং স্পর্শকাতর ছিল যে, বার বার প্রচণ্ড বৈরি পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হয়। ভাগ্য ভাল, চট্টগ্রাম ভার্সিটির সাবেক ভিসি প্রয়াত ড. আবু ইউসূফ আলম সঙ্কট উত্তরণে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়ে উদ্ধারের সরু পথ তৈরি করে দেন। নিজের তেতো অভিজ্ঞতা কারো সাথে শেয়ার করা হয়তো এ’জীবনে সম্ভব হবে না।
নিজেরও অনেক সমস্যা। এক রোখা, গোঁয়ার হিসাবে বেশ ‘সুনাম’ আছে। স্মারকগ্রন্থ প্রকাশনা অনুষ্ঠানে যোগ দিলেও ধস্ত–বিধ্বস্ত হয়ে পড়ি অনাহুত টানাপোড়েনে। এরপর আবারো দূরে সরে যাই। কাছে থেকেও অনেক অনেক দূরে! এর মাঝে ২০১০ সালের সিটি নির্বাচনও হয়ে গেছে। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, তিনি যাকে একবার পছন্দ করেছেন, স্নেহ ও ‘ব্রান্ড গালির ভাণ্ডার’ উজাড় করে তার উপর ঢেলে দিতেন। কিন্তু কোনভাবেই দূরে সরে থাকতে দিতেন না। প্রচণ্ড শক্তিধর চুম্বকের মত কাছে টেনে নিতেন। নিজেই ফোন করতেন বারবার। অনেকবার ধরিনি। কিন্তু ধরা দিতেই হয়।
প্রায় এক বছর পর আবারো চশমা হিলের টিনশেড তীর্থে টেনে নিতে হয় নিজেকে। এভাবে কখনো কাছে, কখনো অনেক দূরে থেকেও সম্পর্কের অম্ল, মধুর– তেতো গিলতে হয়েছে। রমজান মাসে বার বার তার পারিবারিক ও পরে প্রিমিয়ার ভার্সিটির জিইসি ক্যাম্পাসের আলিশান ইফতারিতে তাঁর পাশের আসনটিতে বসতে হয়েছে। ঘরে অথবা ক্যাম্পাস ময়দানে হাজার হাজার মানুষের এই গণ ইফতারে আগামী জীবনে আর অংশ নেয়ার সুযোগ হবে কিনা জানি না।
তিনি কেন আমাকে এতো বেশি পছন্দ এবং না পছন্দের দোলাচলে রাখতেন জানি না। ব্যক্তিগত লাভালাভের হিসাবের বাইরে এ’ধরনের সম্পর্ক তৈরির কোন ঘটনা কখনো খুঁজে পাইনি। অদ্ভুত–আজব এক সম্পর্ক!
যেদিনটার কথা লিখছি, সেটা ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর। ’১৭ অক্টোবর টুম্পার ৬ষ্ট মৃত্যুবার্ষিকী। মহিউদ্দিন ভাইকে রাজনীতি ও সাংবাদিকতা সূত্রে ঘনিষ্ঠভাবে চিনি–জানি ’৮৪ সাল থেকে। ফৌজিয়া সুলতানা টুম্পা মেয়েটার প্রতি কেন তাঁর এত দুর্বলতা তা বুঝতে পারি, টুম্পাকে নিয়ে কাজ করতে গিয়ে। তিনি আগেও টুম্পার প্রসঙ্গ উঠলে চোখের জলে টিস্যু পেপার ভিজাতেন।
দ্রুত আবার সামলে নিতেন। কিন্তু এ’দিনের কিশোরী রাতের ঘটনা একেবারেই ভিন্ন। বারবার তার হিক্কা উঠছে, ঢলে পড়ছেন আমার শরীরে। এই রাতের সাক্ষী ওসমান এবং গাড়ির চালক ছাড়া কান্নার স্রোতে ভেসে যাওয়া চট্টগ্রামের গণ মানুষের এই নেতাটিকে আর কখনো কেউ দেখেছেন কিনা, জানা নেই। গাড়ি কতক্ষণ চলেছে জানি না।
কান্নার সংক্রমণ আমাদেরও ভর করেছে। এক পর্যায়ে নিজকে সামলে নিয়ে বলেন, ‘তোমাকে টুম্পাকে নিয়ে আরেকটি বই তৈরি করতে হবে। আগেরটায় সবকিছু আসেনি, এবার যেন সব আসে’। কেউটের ছোবল খাওয়ার মতো চমকে উঠি। না বলা যে অসম্ভব! মাত্র একুশ বছর বেঁচে থাকা টুম্পাকে নিয়ে আমি নতুন আর কী বা করব? কিন্তু তাকে বোঝাবে, এমন বুকের পাটা কার! টুম্পাকে নিয়ে আবারো কাজে নামতে হয় বাধ্য হয়ে।
দ্বিতীয় বইটা করতে গিয়ে যেসব স্পর্শকাতর অন্দরের টানাপোড়েন কাছ থেকে দেখেছি, তপ্ত ছ্যাঁকা খেয়েছি, তার একমাত্র সাক্ষী তার এপিএস ওসমান গনি। স্পর্শকাতরতার ক্ষত বুকে পুষে কাজটি শেষ করতে হয়। প্রিমিয়ার ভার্সিটির ডেল (ডিপার্টমেন্ট অব ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ এ্যান্ড লিটারেচার) এ্যালামনাই সোসাইটির ব্যানারে আমার সম্পাদনায় বইটি প্রকাশিত হয়। প্রকাশনা অনুষ্ঠানটা বেশ ঘটা করে করার ইচ্ছা ছিল তাঁর।
কীভাবে হয়েছে অবশ্য জানা নেই। কারণ ততদিনে আমি আবার অনেক– অনেক দূরের পথিক। এই বিশাল মানুষটির একাকিত্বসহ আরো অনেক বিশেষ মুহূর্তের প্রত্যক্ষ সাক্ষী আমি। যা কখনো আলোর মুখ দেখবে না। নিজের ভেতরে পুষে রাখা জমাট কষ্টের বরফ ভেঙ্গে শব্দগুলো গল গল করে বের হয়ে এসেছে তাঁর নিজের অজান্তে।
প্রসঙ্গটি এখানেই ইতি টানছি। এখানে একটা কথা বলতেই হয়, টুম্পাকে নিয়ে মহিউদ্দিন ভাইয়ের এত বিপুল আবেগের কারণ; টুম্পার মাঝে তিনি তাঁর বিকল্প সত্ত্বাটি আবিষ্কার করেছেন। তাঁর ধারণা, বেঁচে থাকলে শুধু চট্টগ্রাম নয়, পুরো বিশ্বটাকে জয় করে নিত টুম্পা। এত বেশি মানবিক, সৃজন ও মেধার অধিকারী ছিলেন টুম্পা। তার শিক্ষকরাও একই মন্তব্য করেছেন।
টুম্পাতো আগেই চলে গেছেন। চলে গেছেন চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের কিংবদতন্তীতুল্য জননেতা মহিউদ্দিন চৌধুরী। কিন্তু তাঁর মৃত্যু চট্টগ্রাম তথা পুরো দেশকে যে ঝাঁকুনি দিয়েছে তার রেশ থেকে যাবে অনেকদিন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে এখনো শোকের মাতম।
মূলধারার গণমাধ্যমও পিছিয়ে নেই। একজন মহিউদ্দিন চৌধুরীর মৃত্যু শুধু চট্টগ্রাম নয়, পুরো দেশের মানুষকে আলোড়িত করেছে। এখানে দলমত–পথের কোন বাউন্ডারি লাইন নেই। সর্বস্তরের মানুষ এখনো শোক সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে। একজন মানুষের মৃত্যু কত মহিয়ান–কত গরিয়ান হতে পারে, উজ্জ্বল উদাহরণ দেশবাসীর চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন, চট্টগ্রামের বিরলপ্রজ সিংহ পুরুষ এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী।
তিনি চট্টগ্রামকে ধারণ করেছেন তাঁর অস্তিত্ব জুড়ে। চট্টগ্রামের মানুষের সুখ–দুঃখ, আনন্দ–বেদনা নিজের অনুভূতির সাথে এক সূতোয় বেঁধে নিয়েছেন। বেঁধে নিয়েছেন বলেই চট্টগ্রামের মানুষ পিতাহারা সন্তানের মতো এখনো তার চশমা পাহাড়ের কবরে পিপড়ার সারি বেঁধে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে।
চোখের নোনা স্রোতে কেউ নিরবে, কেউবা বিলাপের হাহাকারে নিজের বুক ভিজাচ্ছেন। একজন ব্যক্তি মহিউদ্দিন, রাজনীতিক মহিউদ্দিন কী করে ব্যক্তির সীমানা প্রাচীর ভেঙে প্রতিষ্ঠানের মর্যাদায় নিজেকে তুলে এনেছেন এটা তিনি নিজেও জানতেন না। মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তাঁকে নিয়ে আলোচনা সমালোচনা–বিতর্কের ছোট বড় অনেক ঢেউ বয়ে গেছে।
কিন্তু মহাপ্রয়াণের সাথে সাথে তা থেমে গেছে। সবার মুখে মুখে এখন কারবালার মাতমের মতো ‘হায় মহিউদ্দিন, হায় মহিউদ্দিন’ ধ্বনীর হাহাকার। একটা মানুষ তার মানবিক কীর্তির বিশাল পর্বত তো একদিনে গড়ে তোলেননি। মিলিয়ন মিলিয়ন ঘণ্টা, বিলিয়ন বিলিয়ন মিনিট তিনি গণ মানুষের কাফেলায় সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
তাঁর নামাজে জানাযায় লাখ লাখ মানুষের জোয়ারে ভেসে গেছে চট্টগ্রাম। তার মহাপ্রয়াণের পর শোকের প্রবল কালো স্রোতে ভাসছে চট্টগ্রাম। বঙ্গবন্ধুর পর চট্টগ্রামের মহিউদ্দিন চৌধুরীর জনপ্রিয়তা কিংবদন্তীকে টক্কর দিয়েছে। জানি না, চট্টগ্রাম তথা দেশের শীর্ষ রাজনীতিকরা মহিউদ্দিন চৌধুরীর জনপ্রিয়তার উৎসটি ধারণ করতে পারেন কিনা, পারলে তাদেরও লাভ, দেশেরও লাভ।
জিদ নয়, প্রশ্ন নয়, যেন এক চাবুক এসে পড়ল রেহানা বেগমের ব্যস্ত জীবনে। হতভম্বের মত ছেলের মুখের দিকে চেয়ে অনড় দাঁড়িয়ে রইল সে। এদিকে মোবাইলের রিং টোন একটানা বাজতেই থাকলো।
মোস্তফা কামাল পাশা
No comments