ছদ্মবেশে বঙ্গবন্ধুর মাজারে যান আলহাজ্ব এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী।
দক্ষিণ কাট্টলী থেকে শ্বেতপাথরে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান’লিখে নিয়ে সেটা বঙ্গবন্ধুর কবরে লাগিয়ে দিই।
হুলিয়া মাথায় নিয়ে ৭৯ সালের দিকে গোপনে দেশে ফেরেন আলহাজ্ব এবিএম মহিউদ্দিন। জিয়া সরকার শুরু থেকেই তাদের প্রতিরোধের সিদ্ধান্ত নিয়ে সেনাবাহিনী লেলিয়ে দেন। এর মধ্যেই একদিন ছদ্মবেশে এবিএম মহিউদ্দিন যান টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মাজারে।মাজার বলতে কিছু ছিলনা। বাঁশের সীমানাও ভালভাবে ছিলনা।
যখন পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়, আমি চট্টগ্রাম থেকে নির্মাণ শ্রমিক নিয়ে যায়। গোপালগঞ্জ তো বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত ছিল। ফরিদপুর থেকে ইট আর সিমেন্ট সংগ্রহ করি। বঙ্গবন্ধুর কবর ঘিরে পাকা দেয়াল তুলে দিই। দক্ষিণ কাট্টলী থেকে শ্বেতপাথরে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান’লিখে নিয়ে সেটা কবরে লাগিয়ে দিই। এ পর্যায়ে বলতে গিয়ে আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়েন এবিএম মহিউদ্দিন। কিছুক্ষণ মাথায় হাত দিয়ে চুপ করে থাকেন।
মুক্তিযুদ্ধের আগ থেকেই জ্যেষ্ঠ নেতাদের পাশাপাশি চট্টগ্রামে তরুণ-যুবকদের আরও একটি রাজনৈতিক ধারা সক্রিয় ছিল। তারা ছিলেন যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল হক মণি’র অনুসারী। এই ধারার নেতারা মিলে একাত্তরে জয় বাংলা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে তারা চট্টগ্রামে সর্বপ্রথম পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে কালো পতাকা উত্তোলন করেছিলেন।
সেই জয় বাংলা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন তখনকার যুব নেতা মৌলভী সৈয়দ এবং শ্রমিক নেতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। ছিলেন তখনকার ছাত্রনেতা মোছলেম উদ্দিন আহমেদ, অমল মিত্র, শফিউল বশর, এস এম কামাল উদ্দিন, এস এম ইউসুফ, কাজী ইনামুল হক দানু, সুলতানুল কবির চৌধুরীসহ আরও অনেকে। তাদের ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক পথচলা অব্যাহত ছিল মুক্তিযুদ্ধের পরেও।
বঙ্গবন্ধু যখন বাকশাল করলেন, তখন শ্রমিক নেতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীকে ১১ সদস্যবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় শ্রমিক ফ্রন্টের অন্যতম সদস্য করা হয়। হত্যাকান্ডের রাতে মহিউদ্দিন ঢাকায় কমলাপুরের একটি হোটেলে ছিলেন। ওই রাতের প্রায় ১০টা পর্যন্ত মহিউদ্দিন ছিলেন রাজনৈতিক গুরু শেখ মণি’র বাসায় যাকেও রেহাই দেননি ঘাতকেরা। ভাতও খেয়েছেন শেখ মণির সঙ্গে। সকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর সঙ্গে মহিউদ্দিনের বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যাবার কথা ছিল।
রিক্সায় বসে দেখি চারদিক থমথমে। সকাল ৭টার দিকে হঠাৎ একটি দোকানের ভেতরে রেডিওতে শুনি ডালিমের কন্ঠ। শুনলাম, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে। দিশেহারা হয়ে আমি রিক্সা থেকে নেমে যাই। মানুষের কাছ থেকে শুনলাম, মণি ভাইকেও নাকি খুন করা হয়েছে। তড়িৎ গতিতে সিদ্ধান্ত নিলাম, চট্টগ্রাম চলে যাব বলেন মহিউদ্দিন।
তিনি বলেন, ঢাকা থেকেই আমি চট্টগ্রামের জিওসি গোলাম দস্তগীরের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি খুব উত্তেজিত ছিলেন। তিনি বললেন,আপনারা সবাই সংগঠিত হোন,প্রতিবাদ করুন। কিন্তু চট্টগ্রামে যারা সিনিয়র লিডার ছিলেন তাদের অনেকের সঙ্গেই তখন যোগাযোগ করতে পারিনি। প্রায় সবাই আত্মগোপনে ছিলেন।এক সপ্তাহের মধ্যে আমি চট্টগ্রামে ফিরে আসি। কথা বলার সময় রাজনৈতিক সহচর অমল মিত্রকেও পাশে নেন মহিউদ্দিন। দু’জন মিলে সেই দুঃসহ স্মৃতির ঝাঁপি খুলে দেন।
পঁচাত্তরের অক্টোবরে গ্রেপ্তার হয়ে যান মহিউদ্দিন। সামরিক আইনে গ্রেপ্তারের প্রায় ছয় মাস পর রাজশাহী কারাগার থেকে মুক্তি পান মহিউদ্দিন।ততদিনে তার রাজনৈতিক সহচরদের অনেকেই চলে গেছেন ভারতে। মুক্তি পেয়ে মহিউদ্দিনও যান সেখানে।
অমল মিত্র বলেন,আগরতলায় ক্যাম্প করে আমরা প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করি।হিমালয়ের তান্দুয়ায় হয় উচ্চতর প্রশিক্ষণ। আওয়ামী লীগের এমপি চিত্তরঞ্জন সুথার আমাদের ভারতে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি কয়েকজন এমপি’র মধ্যে একজন যিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার সশস্ত্র প্রতিবাদের পরিকল্পনা করেছিলেন।
৭৬ সালে মার্চে মহিউদ্দিন ভাই গিয়ে আমাদের সঙ্গে যোগ দেন। সেখানে মৌলভী সৈয়দ, এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী, অমল মিত্র, অমলেন্দু সরকার, শফিউল বশর, সন্তোষ ধর, ফরিদপুরের সালাহউদ্দিন, পটুয়াখালীর বর্তমান জেলা পরিষদ প্রশাসক খান মোশাররফ, গৌরনদীর সন্তোষ, ফারুক, নড়াইলের শাহজাহান, মাঈদুল ইসলাম, মাহফুজুল আলম বেগ, চট্টগ্রামের এস এম ইউসুফ (ছদ্মনাম ছিল শামীম) সশস্ত্র প্রতিবাদের প্রশিক্ষণার্থীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন।
প্রথমে থানা-ফাঁড়ি আক্রমণ করব, রাস্তায় রাস্তায় গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটাব। চট্টগ্রাম বন্দরকে নিজেদের আয়ত্তে নেব। চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করে দেব। এটাই ছিল আমাদের পরিকল্পনা। বলেন মহিউদ্দিন।
অমল মিত্র জানান,৭৭ সালের প্রথমদিকে তারা হাতে তৈরি কিছু গ্রেনেড পাঠান। এসএম কামালউদ্দিনের সেগুলো কৈবল্যধাম থেকে নিয়ে যাবার কথা ছিল। কিন্তু গোলদার নামে এক আওয়ামী লীগ কর্মী সেগুলো চট্টগ্রাম স্টেশনে আনতে গিয়ে ধরা পড়ে যান।
প্রশিক্ষণ নিয়ে কেউ কেউ চট্টগ্রামে ফিরে গ্রেনেড বানাতে শুরু করেন। বলুয়ারদিঘির পাড়ের আবু তালেব আর আবু কালাম গ্রেনেডগুলো নিজেদের হেফাজতে রাখতেন। আগ্রাবাদ-আন্দরকিল্লায় কয়েক দফা গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছিল। এস এম কামাল উদ্দিন অস্ত্র সংগ্রহ করেছিলেন।
১৯৭৭ সালের মাঝামাঝিতে ভারতের রাজনৈতিক দৃশ্যপট পাল্টে যায়। বাংলাদেশেও ক্যু, পাল্টা ক্যু’র ধারাবাহিকতায় ক্ষমতায় আসে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান।
প্রশিক্ষণরত নেতাকর্মীদের অনেককে পুশ ব্যাক করে ভারত। টিকতে না পেরে অনেকেই বাংলাদেশে ফিরে আসেন। এতে সশস্ত্র প্রতিবাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ছেদ পড়ে।
মৌলভী সৈয়দ, মহিউদ্দিন, অমল মিত্র, অমলেন্দু সরকারসহ ৩০-৪০জন ভারতে থেকে যান। তখন আরও দু:সহ অবস্থা। সেখানে থাকতে তাদের অনেককে পরিচয় গোপন করতে হয়েছে। কেউ মারা গেলে চুরি করে দাফন করতে হত। তবে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু তাদের সহযোগিতা করেছিলেন বলে জানান এবিএমমহিউদ্দিন চৌধুরী।
বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করতে হয়েছে তাদের। নেতা হিসেবে সহকর্মীদের থাকা-খাওয়ার দায়িত্ব এসে পড়ে এবিএমমহিউদ্দিন চৌধুরীর উপর। কোলকাতার শিয়ালদহ স্টেশনে পত্রিকা বিক্রি শুরু করেন এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। সেটা জানাজানি হয়ে গেলে পেশা পরিবর্তন করেন তিনি। সাঙ্গু ভ্যালি নামে একটি রেস্টুরেন্টে বয় হিসেবে চাকুরি নেন।
No comments