ইসলামকে বলা হয়, স্বভাবগত বা প্রকৃতির ধর্ম-বৃক্ষ রোপণে মহানবী (সা.) এর উৎসাহ।
গাছ মানুষ ও পরিবেশের অকৃত্রিম বন্ধু। সবুজ গাছপালার ওপরই নির্ভর করে মানুষসহ অন্যান্য প্রাণীর টিকে থাকা। এই গাছ ইচ্ছা হলেই কাটা যাবে না।
ইসলামকে বলা হয়, স্বভাবগত বা প্রকৃতির ধর্ম। সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ মূলত সামাজিক জীব। মানুষকে ঘিরেই পরিবেশ-প্রকৃতি ও সমাজের সৃষ্টি। আর পরিবার, পরিবেশ ও সমাজ নিয়ে ইসলামের পরিবেশগত চিন্তা-ভাবনা রয়েছে। এ প্রসঙ্গে কুরআনে কারিমে ইরশাদ হচ্ছে,
وَ اٰیَۃٌ لَّهُمُ الۡاَرۡضُ الۡمَیۡتَۃُ ۚۖ اَحۡیَیۡنٰهَا وَ اَخۡرَجۡنَا مِنۡهَا حَبًّا فَمِنۡهُ یَاۡکُلُوۡنَ
‘তাদের জন্য নিদর্শন একটি মৃতভূমি। আমি একে সঞ্জীবিত করি এবং তা থেকে উৎপন্ন করি শস্য, তারা তা ভক্ষণ করে। আমি তাতে উৎপন্ন করি খেজুর এবং প্রবাহিত করি ঝর্ণাধারা, যাতে তারা ফল খায়।’ (সূরা ইয়াসিন, আয়াত ৩৩)।
পরিবেশের বাহ্যিক আরেকটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান হচ্ছে আলো। কুরআনে কারিমে আলো-আঁধার, দিন-রাত সম্পর্কে অনেক আয়াত রয়েছে। ইরশাদ হয়েছে,
اَلَمۡ یَرَوۡا اَنَّا جَعَلۡنَا الَّیۡلَ لِیَسۡکُنُوۡا فِیۡهِ وَ النَّهَارَ مُبۡصِرًا ؕ اِنَّ فِیۡ ذٰلِکَ لَاٰیٰتٍ لِّقَوۡمٍ یُّؤۡمِنُوۡنَ
‘তারা কি অনুধাবন করে না, আমি রাত সৃষ্টি করেছি তাদের বিশ্রামের জন্য এবং দিনকে করেছি আলোকিত। এতে মুমিন সম্প্রদায়ের জন্য অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে।’ (সূরা নমল, আয়াত ৮৬)।
পরিবেশ সুস্থ, সুন্দর ও
পরিচ্ছন্ন রাখতে রয়েছে ইসলামের তাকিদ। ইরশাদ হয়েছে,
وَ لَا تُلۡقُوۡا بِاَیۡدِیۡکُمۡ اِلَی التَّهۡلُکَۃِ
‘তোমরা নিজেদের ধ্বংস নিজেরা ডেকে
এনো না।’ (সূরা বাকারা, আয়াত ১৯৫)।
অন্য আয়াতে বলা হয়েছে,
ظَهَرَ الۡفَسَادُ فِی الۡبَرِّ وَ الۡبَحۡرِ بِمَا کَسَبَتۡ اَیۡدِی النَّاسِ لِیُذِیۡقَهُمۡ بَعۡضَ الَّذِیۡ عَمِلُوۡا لَعَلَّهُمۡ یَرۡجِعُوۡنَ
মানুষের কৃতকর্মের দরুন জলে-স্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে; যাতে ওদের কোন কোন কর্মের শাস্তি ওদেরকে আস্বাদন করানো হয়। যাতে ওরা (সৎপথে) ফিরে আসে। (সূরা আর রুম, আয়াাত ৪১)।
পরিবেশ দূষণ থেকে বাঁচতে
হলে পরিচ্ছন্নতা অপরিহার্য। কুরআনে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও পবিত্রতা সম্পর্কে
অনেকবার বলা হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে,
اِنَّ اللّٰهَ یُحِبُّ التَّوَّابِیۡنَ وَ یُحِبُّ الۡمُتَطَهِّرِیۡنَ
‘আল্লাহ তওবাকারীদের ভালোবাসেন এবং
যারা পবিত্র থাকে তাদেরও। (সূরা বাকারা, আয়াত ২২২)।
وَ الۡاَرۡضَ مَدَدۡنٰهَا وَ اَلۡقَیۡنَا فِیۡهَا رَوَاسِیَ وَ اَنۡۢبَتۡنَا فِیۡهَا مِنۡ کُلِّ زَوۡجٍۭ بَهِیۡجٍ ۙ
আমি পৃথিবীকে বিস্তৃত করেছি এবং তাতে পর্বতমালা স্থাপন করেছি এবং ওতে উদগত করেছি চোখ-জুড়ানো নানা প্রকার উদ্ভিদ।
আমাদের চারপাশে যা কিছু
রয়েছে এবং যা প্রাকৃতিক পরিবেশ হিসেবে খ্যাত, এগুলো মহান স্রষ্টার অপার নেয়ামত। এ
প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে—
وَ الۡاَرۡضَ
مَدَدۡنٰهَا وَ اَلۡقَیۡنَا فِیۡهَا رَوَاسِیَ وَ اَنۡۢبَتۡنَا فِیۡهَا مِنۡ کُلِّ شَیۡءٍ مَّوۡزُوۡنٍ
‘আমি
পৃথিবীকে বিস্তৃত করেছি ও এতে পর্বতমালা স্থাপন করেছি এবং আমি পৃথিবীতে প্রতিটি
বস্তু সুপরিমিতভাবে উত্পন্ন করেছি।
وَ جَعَلۡنَا لَکُمۡ
فِیۡهَا مَعَایِشَ وَ مَنۡ لَّسۡتُمۡ لَهٗ بِرٰزِقِیۡنَ
আমি তোমাদের জন্য
তাতে জীবিকার ব্যবস্থা করেছি এবং তোমরা যাদের রিজিকদাতা নও, তাদের জন্যও।
وَ اِنۡ مِّنۡ شَیۡءٍ
اِلَّا عِنۡدَنَا خَزَآئِنُهٗ ۫ وَ مَا نُنَزِّلُهٗۤ اِلَّا بِقَدَرٍ مَّعۡلُوۡمٍ
প্রতিটি বস্তুর ভাণ্ডার
আমার কাছে আছে এবং আমি তা প্রয়োজনীয় পরিমাণেই সরবরাহ করে থাকি।
وَ اَرۡسَلۡنَا
الرِّیٰحَ لَوَاقِحَ فَاَنۡزَلۡنَا مِنَ السَّمَآءِ مَآءً فَاَسۡقَیۡنٰکُمُوۡهُ
ۚ وَ مَاۤ اَنۡتُمۡ لَهٗ بِخٰزِنِیۡنَ
আমি বৃষ্টিগর্ভ বায়ু প্রেরণ করি, অতঃপর আকাশ থেকে বারিধারা বর্ষণ করি এবং তা তোমাদের পান করতে দিই, বস্তুত এর ভাণ্ডার তোমাদের কাছে নেই। ’ (সুরা হিজর, আয়াত: ১৯-২২)
প্রাকৃতিক পরিবেশ
সংরক্ষণে মহানবী (সা.)
মানুষের অপরিকল্পনা, অদূরদর্শিতা ও অমানবিক কর্মকাণ্ডের কারণে বর্তমানে প্রকৃতিতে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়েছে। এটি সারা বিশ্বের মানুষের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। ফলে বায়ুতে দূষণ, তাপমাত্রা, রোগ-বালাই ও প্রাকৃতিক নানান দুর্যোগ বেড়ে চলেছে। তাই এসব বিপর্যয় থেকে বাঁচার জন্য বিজ্ঞানীরা বনরক্ষা ও বৃক্ষ রোপণকে অন্যতম উপায় বলে অগ্রাধিকার দিয়েছেন।
অথচ মহানবী (সা) সেই চৌদ্দশ বছর আগে বৃক্ষ বা বন রক্ষার জন্য তাগিদ দিয়েছেন। বৃক্ষ বা শস্য নষ্ট করাকে নিরুৎসাহিত করে তিনি মানুষকে উপদেশ দিয়েছেন। জনৈক ব্যক্তি একটি গাছের পাতা ছিঁড়লে রাসুল (সা.) বলেন, ‘প্রত্যেকটি পাতা আল্লাহর মহিমা ঘোষণা করে। ’
বৃক্ষ রোপণে মহানবী
(সা.) এর উৎসাহ
গাছ-পালা, লতা-পাতা মানুষ ও জীবজন্তুর জন্য খাদ্য সরবরাহ করে, মানুষ ও জীবের জন্য অক্সিজেন সরবরাহ করে এবং পরিবেশকে দূষণমুক্ত করে। গাছপালা ঝড়-ঝঞ্ছা প্রতিরোধ করে এবং মাটির ক্ষয়রোধ করে। এ প্রসঙ্গে আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে প্রিয়নবী (সা.) বলেছেন, ‘কোনো মুসলমান যদি একটি বৃক্ষের চারা রোপণ করে অথবা ক্ষেতখামার করে, অতঃপর তা মানুষ, পাখি কোনো জন্তু ভক্ষণ করে, তা তার জন্য সদকার সওয়াব হবে। ’ (মুসলিম, হাদিস: ৫৫৩২)
আয়েশা (রা) হতে বর্ণিত হাদিসে নবী কারীম (সা.) বলেছেন, ‘যদি নিশ্চিতভাবে জানো যে, কেয়ামত এসে গেছে, তখন হাতে যদি একটি গাছের চারা থাকে যা রোপণ করা যায়, তবে সেই চারাটি লাগাবে। ’ (মুসলিম , হাদিস: ৫৫৬০)
আমরা জানি, গাছ মানুষ ও পরিবেশের অকৃত্রিম বন্ধু। সবুজ গাছপালার ওপরই নির্ভর করে মানুষসহ অন্যান্য প্রাণীর টিকে থাকা। এই গাছ ইচ্ছা হলেই কাটা যাবে না। কারণ ‘গাছের প্রাণ আছে’- এটা হাদিসের বাণী। হাদিসে রাসূল (সা.) থেকে জানা যায়, এক লোক যখন অকারণে একটি গাছের ডাল ভাংছিল তখন নবী করিম (সা.) সে লোকটির চুল মৃদুভাবে টান দিয়ে বলেন, তুমি যেমন শরীরে আঘাত পেলে ব্যথা পাও, গাছের পাতা বা ডাল ছিঁড়লে গাছও তেমন ব্যথা পায়। পরিবেশের ভারসাম্যের জন্য গাছ লাগানোর শিক্ষা আমরা মহানবী (সা.)-এর হাদিস থেকে পাই। তিনি বলেছেন, যদি তুমি মনে করো আগামীকাল কিয়ামত হবে, তবু আজ একটি গাছ লাগাও।
সুন্দর ও শৃঙ্খলাপূর্ণ সামাজিক পরিবেশ গঠনে খাল-বিল, পুকুর-ডোবা, রাস্তাঘাট পরিষ্কার থাকা অপরিহার্য। নবী (সা.) বলেছেন, ইমানের ৭৩টি শাখা; তন্মধ্যে সর্বোত্তমটি হলো, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ; আর সর্বনিম্নটি হলো, রাস্তা থেকে ক্ষতিকারক বস্তু দূরীভূত করা।
তিনি আরও বলেছেন, পবিত্রতা ইমানের অর্ধাংশ। হজরত জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, রাসূল (সা.) পানিতে প্রস্রাব করতে নিষেধ করেছেন। হজরত মোয়াজ বিন জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেছেন, তোমরা লানত পাওয়ার ৩টি কাজ অর্থাৎ পানির ঘাট, রাস্তার মাঝে এবং বৃক্ষের ছায়াতলে মলত্যাগ থেকে বিরত থাক।
আমরা অনেক সময় হাঁচি-কাশি দেওয়ার সময় মুখ ঢাকি না। এতে করে নির্গত ময়লা ও জীবাণু দ্বারা অন্যের ক্ষতি হতে পারে। হজরত আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, রাসূল (সা) যখন হাঁচি দিতেন, তখন তিনি মুখ ঢেকে নিতেন।
বস্তুত, আল্লাহতায়ালা এ পৃথিবী নামক ছোট গ্রহকে জীবের বেঁচে থাকার জন্য সব উপাদান দিয়ে পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন। কিন্তু আমাদের নানাবিধ অত্যাচারে পৃথিবীর পরিবেশ দিন দিন উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। ফলে জীবের বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়ছে। বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার পরিবেশ হারাচ্ছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
পৃথিবীতে মানুষকে টিকে থাকতে হলে, সুস্থ ও সুন্দর পরিবেশের নিশ্চয়তা নিজেদেরই দিতে
হবে। পরিবেশ সংরক্ষণে ইসলামের অনন্য নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়ন করলে পরিবেশের
ভারসাম্য রক্ষা পেয়ে একটি সুস্থ পরিবেশ বিশ্বব্যাপী গড়ে উঠবে।
No comments