Header Ads



একজন মহিউদ্দিন চৌধুরী বহুকালের সাধনা- মহিউদ্দিন চৌধুরীরা যুগে যুগে জন্মে না।

 

একজন মহিউদ্দিন চৌধুরী বহুকালের সাধনা

"রাজনীতির দরবেশ"মহিউদ্দিন চৌধুরী”

শিরোনামটি দেখে অনেকের মনে হয়ত প্রশ্ন জাগতে পারে, ' রাজনীতির দরবেশ ' মানে কি ? দরবেশ ফার্সী শব্দ। বাংলায় এই শব্দের অর্থ হচ্ছে সাধক। যাঁরা আল্লাহর জ্ঞান সাধনায় রত থেকে কামেলিয়াত তথা আধ্যাত্মিকতার চরম শিখরে পৌঁছুছেন তাঁদেরকে বলা হয় ফার্সী ভাষায় 'দরবেশ।'বাংলা ভাষায় সাধক।

রাজনীতির জ্ঞান সাধনায় চট্টল বীর মরহুম আলহাজ্ব এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী তৃণমূল থেকে গণ মানুষের রাজনীতির সর্বোচ্চ স্থানে আরোহণ করেছিলেন। সেই অর্থে আমি বলব, মহিউদ্দিন চৌধুরী 'রাজনীতির দরবেশ' তথা রাজনীতির সাধক।

রাজনীতি অনেকেই করেছেন। কিন্তু, সবাই শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, সোহরাওয়ার্দী, ভাসানী, বঙ্গবন্ধু হতে পারেন নি।

রাজনীতি করে কেউ হয়েছেন ইতিহাসের নায়ক আর কেউ হয়েছেন খল নায়ক। ইতিহাসের মূল্যায়নে এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী ছিলেন রাজনীতির নায়ক। পবিত্র হাদিস শরীফে বলা হয়েছে, " মানুষের মধ্যে উত্তম ব্যক্তি তিনি যিনি মানুষের কল্যাণ করেন।" মহিউদ্দিন চৌধুরীর কর্ম ও জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তিনি আজীবন মানবতার কল্যাণে নিয়োজিত ছিলেন। যেখানেই মানবতা ভূলুন্ঠিত সেখানেই তিনি ছুটে গেছেন। দুঃস্থ ও অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের প্রলয়ংকরী ঘূর্নিঝড়ে বিধ্বস্থ পতেঙ্গা- হালিশহর- কাট্টলী অঞ্চলে শত শত লাশকে তিনি নিজ কাঁধে বয়ে ধর্মীয় মর্যাদায় সমাহিত করেছেন।

বিকৃত লাশের উদ্ভট গন্ধে মানুষ যখন কাছে যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না সেখানে মুখে রুমাল বেঁধে দুঃসাহসী মহিউদ্দিন কর্তৃক খাটিয়ায় লাশ বহনের দৃশ্য এখনও চোখের পর্দায় ভেসে উঠে। ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী সময়ে চট্টগ্রামের মুসলিম হলে ক্যাম্প স্থাপন করে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত অসুস্থদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন মানবতার সেবক মহিউদ্দিন চৌধুরী। উদ্বাস্তু মানুষের আশ্রয়ে খোলেন লঙ্গরখানা।

চট্টগ্রামে নৌ সেনাদের সাথে এলাকাবাসীর সহিংস ঘটনার পর নিহত সাধারণ মানুষের লাশ উদ্ধার, স্বহস্তে লাশ ধোয়া ও দাফন কার্যে মহিউদ্দিন চৌধুরীর বীরোচিত ভূমিকার কথা চট্টলাবাসী ভুলে যায় নি। তাইতো, তাঁর সম্পর্কে একটি জনপ্রিয় শ্লোগান ছিল " সুখে- দুঃখে যাঁকে পাই, সে আমাদের মহিউদ্দিন ভাই।"

১৯৯৪ সালে চট্টগাম সিটি কর্পোরেশনের প্রথম মেয়র নির্বাচনের সময় শত নাগরিক কমিটির পোষ্টারে লাশের খাটিয়া বহনের ছবি সত্যিই মহিউদ্দিন চৌধুরীকে " রাজনীতির দরবেশ " হিসাবে চট্টলাবাসী তাদের হৃদয় রাজ্যে বরণ করে নিয়েছিল। পোষ্টারের ক্যাপশনে ' মানুষ মানুষের জন্য' এই নীতিবাক্যটির সাথে ব্যক্তি মহিউদ্দিনের চরিত্রের দারুণ মিল দেখে মানুষ খুঁজে পেয়েছিল তাদের আস্থা ও বিশ্বাসের ঠিকানা। আমি মনে করি, এখানেই আমার নিবন্ধ " রাজনীতির দরবেশ মহিউদ্দিন " শিরোনামের সার্থকতা।

মহিউদ্দিন চৌধুরী কখনও তোষামুদি রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি তৈল মর্দন রাজনীতি করতেন না। তিনি যা' ন্যায্য মনে করতেন তাই করতেন। নিজ দলের কিংবা দলীয় সরকরের কোন সিদ্ধান্ত অপছন্দ হলে তিনি প্রতিবাদ করতেন। এখানেই অন্যান্য রাজনীতিবিদদের সাথে মহিউদ্দিন চৌধুরীর পার্থক্য। সরকারী দল কিংবা বিরোধী দলে যখন যে অবস্থায় ছিলেন চট্টগ্রামের স্বার্থের ব্যাপারে তিনি কখনও আপোষ করেন নি। অতীতে অনেক নেতাকেই দেখেছি, পদ হারানোর ভয়ে কিংবা দলীয় শীর্ষ নেতৃত্বের বিরাগভাজন হওয়ার আশংকায় চট্টগ্রামের স্বার্থ বিরোধী কর্মকান্ডে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন। যা' বর্তমান নেতাদের মধ্যেও দৃশ্যমান। এই ক্ষেত্রে মহিউদ্দিন চৌধুরী ছিলেন একমাত্র ব্যতিক্রম। সেইজন্যই তো শ্লোগান শুনতাম, " বীর মহিউদ্দিন চট্টলার/ রুখা মহিউদ্দিন সাধ্য কার। "

আসলে ব্যক্তি স্বার্থ, পদ- পদবীর লোভ- মোহে অনেক নেতা এমনই অন্ধ হয়ে যান যে, সত্য উচ্চারণে তা্ঁদের বিবেক- বুদ্ধি সব কিছুই লোপ পায়। অন্যায় দেখেও না দেখার ভান করে। এড়িয়ে চলে। এই সকল মেরুদন্ডহীন নেতাদের সাথে মহিউদ্দিন চৌধুরীর পার্থক্য এখানেই। লোভ- লালসা ছিল না বলেই তাঁর কন্ঠে জোর ছিল। শক্ত ছিল মেরুদন্ড। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ গত ১৪ জানুয়ারী লালদিঘি ময়দানের শোকসভায় বলেছেন,"নেতারা যখন কেন্দ্রে পদ পাবার জন্য উদগ্রীব থাকেন,২০০৯ সালে মহিউদ্দিন চৌধুরী সেই সুযোগ পেয়েও প্রেসিডিয়ামের পদ নেন নি। তিনি তখন নেত্রীকে বলেছিলেন,আমি চট্টগামের মানুষের সুখে -দুঃখে থাকতে চাই। আমি চট্টগ্রামের মানুষের পাশে থাকতে চাই। এই ধরণের নেতা এখন বিরল ( সূত্রঃ পূর্বকোণ ১৫/০১/২০১৮)।

পরিবারের সুখ- দুঃখ দেখভাল করার জন্য যেমন একজন অভিভাবকের প্রয়োজন হয়, ঠিক তেমনি মহিউদ্দিন চৌধুরী ছিলেন চট্টগ্রামের অভিভাবক। তাঁর মৃত্যুতে অভিভাবকহীন হয়ে গেল চট্টগ্রাম। মরহুম নেতার প্রিয় চট্টলাবাসীর মাথার উপর থেকে যেন সরে গেল একটি ছায়া। অন্যায়- অবিচার- শোষণ- বঞ্চনার বিরুদ্ধে একটি সরব প্রতিবাদী কন্ঠ স্তব্ধ হয়ে গেল চিরতরে।

প্রিয় নেতার মৃত্যুতে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, চট্টগাম বিশ্ব বিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডঃ মইনুল ইসলাম স্যার বলেছেন, "চট্টগ্রামের ন্যায্য স্বার্থে যে কোন মহল থেকে আঘাত আসলে সবার আগে গর্জে উঠতেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে প্রতিবারই নেতৃত্ব দিতেন অকুতোভয়ে। এমন কি চট্টগ্রামের বঞ্চনা যদি নিজ দলের শীর্ষ নেতৃত্বের ভুল সিদ্ধান্তের ফসলও হয় তাতেও ঐ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বারবার রুখে দাঁড়িয়েছেন তিনি। এজন্য, বেশ কয়েকবার দলীয় প্রধানমন্ত্রীর বৈরিতার শিকারও হতে হয়েছে তাঁকে। কিন্তু, তিনি ন্যায়ের পথ থেকে বিচ্যুত হন নি। ১৯৯৬- ৯৭ সালে মহিউদ্দিন চৌধুরী চট্টগ্রাম বন্দরে এসএসএ'র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটি গাঁড়ার পাঁয়তারাকে যেভাবে রুখে দিয়েছিলেন সেজন্য তিনি বাংলা দেশের ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছেন (সূত্রঃ পূর্বকোণ ১৬/১২/২০১৭ সংখ্যা)।"

রাজনীতির সাধক মহিউদ্দিন চৌধুরী ইচ্ছে করলে কাড়ি কাড়ি অর্থের বিনিময়ে চট্টগ্রাম বন্দরকে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটি করার সুযোগ করে দিতে পারতেন। কিন্তু, তিনি তা' করেন নি। মহিউদ্দিন চৌধুরী ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর আদর্শে গড়া একজন খাঁটি সৈনিক।

বঙ্গবন্ধু চাইলে ৬ দফার কিছু দফা ছাড় দিয়ে ইয়াহিয়া-ভুট্টোর সাথে আপোষ করে পাকিস্থানের প্রধান মন্ত্রী হয়ে যেতে পারতেন। তবে, ' 'জাতির জনক বঙ্গবন্ধু'হতে পারতেন না। মহিউদ্দিন চৌধুরীও চাইলে ব্যক্তি স্বার্থে চট্টগ্রামের স্বার্থ বিরোধী অনেক বিষয়ে আপোষ করতে পারতেন। তবে, " চট্টল বীর " খেতাবের অধিকারী হতে পারতেন না। সাধারণ গণ মানুষের অবিসংবাদিত নেতা হতে পারতেন না। মহিউদ্দিন চৌধুরীর সম-সাময়িক বেশ কিছু নেতা এখনও নেতৃত্বের গুণাবলীতে তাঁর ধারে কাছে পৌঁছানোও সম্ভব হয় নি।

মহিউদ্দিন চৌধুরী ছিলেন আজীবন বঙ্গবন্ধুর অনুসারী একজন নিবেদিত প্রাণ নেতা। শীত- গ্রীষ্ম- বর্ষায় সফেদ পায়জামা- পাঞ্জাবীর উপর " মুজিব কোট " পরিধান করতে তিনি কখনও ভুলেন নি। স্যুট- টাই পরিহিত অবস্থায় কেউ কোন দিন দেখে নি।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্টের পট পরিবর্তনের পরে তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের পৃষ্টপোষকতায় যখন মু্ক্তিযুদ্ধ

ও স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃতির ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল তখন জন্ম পরম্পরায় মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস পৌঁছে দেওয়ার জন্য ১৯৮৮ সালে বীর মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দিন চৌধুরী সর্ব প্রথম চট্টগ্রাম সার্কিট হাউস মাঠে আয়োজন করেন মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলা। অশুভ শক্তি বীর বাঙালীর অহংকার বিজয় মেলার বিরুদ্ধে নানাবিধ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল সেদিন। কিন্তু, অকুতোভয় বীর মহিউদ্দিনের নেতৃত্বে মুুক্তিযোদ্ধা-জনতার সম্মিলিত শক্তির নিকট স্বাধীনতা বিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি ঠিকে থাকতে পারে নি বলেই আজ বিজয় মেলা বাঙালির ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। শুধু তা' নয়, অনন্য গুণে গুণান্বিত এই নেতার চিন্তার ফসল বিজয় মেলা আজ সারা বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করেছে।

মহিউদ্দিন চৌধুরী যেমন একজন খাঁটি বাঙালী ছিলেন তেমনি ছিলেন একজন খাঁটি মুসলমান। সরকারী হজ্বযাত্রীদের বিভিন্ন বিড়ম্বনা ও হয়রানী থেকে মুক্ত করে আল্লাহ্ র মেহমান হাজীদের প্রকৃত সেবা প্রদানের জন্য তিনি ১৯৯৬ সালে গঠন করেন বাংলাদেশে সর্ব প্রথম বেসরকারী ব্যবস্থাপনায় মেয়র হজ্ব কাফেলা। এই কাফেলার মাধ্যমে মহিউদ্দিন চৌধুরী প্রতি বছর হজ্ব কাফেলায় গিয়ে হাজীদের খেদমত করতেন। সঙ্গী হাজীদের কাপড় ধুয়ে দিতেন। মিনার তাঁবুতে, আরাফাতের তাঁবুতে নামাজ একামত দিতেন। আরাফাতের ময়দানে মেয়র কাফেলার তাঁবুতে বিশাল ডেকচিতে শরবত বানিয়ে নিজ হাতে হাজী ভাইদেরকে খাওয়ানোর সেই দৃশ্য আগামীতে আর দেখা যাবে না।]

 

মহিউদ্দিন চৌধুরীর মহা প্রয়াণে নিজামউদ্দিন জামি নামে এক ভক্ত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছেন, " একজন মহিউদ্দিন চৌধুরী বহুকালের সাধনা/ মহিউদ্দিন চৌধুরীরা যুগে যুগে জন্মে না।"

রাজনীতির দরবেশ, চট্টল বীরের মৃত্যুতে তাঁর নামের আদ্যাক্ষর দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে শোকগাঁথা

লিখেছিলাম আজ ২৩ জানুয়ারী ২০১৮ তাঁর প্রয়াণের ৪০ তম দিবসে' শোকগাঁথাটি উপস্থাপন করে নিবন্ধের ইতি টানছি-----

এ--সেছিলে কেন চলে যাবে যদি

বি--রহে বিচ্ছেদে মোরা আজ কাঁদি,

এ--মনিতে শোকাতুর ব্যথায় ভরপুর--

ম--ন সবার তব বেদনা বিধূর।

ম--রিয়া তুমি হইয়াছ যে অমর,

হি--রম্ময় সন্তানের বিয়োগে মোরা কাতর।

উ--র্মি জেগেছিল সেদিন জনতার সাগরে--

দি--ন মজুর, শ্রমিক সব এক কাতারে।

দি--বস- রজনী চলেছে শোকের মাতম,

ন--র- নারীর অবিরাম করুণ রোদন।

চৌ--চির হয়েছে বুক গভীর আহাজারীতে

ধু--প কাঠির মত জ্বলবে মোদের অন্তরেতে,

রী--তিনীতিতে অনন্য তুমি, অতুলনীয় বীরের গুণেতে।

লেখক : মুসলেহ উদ্দিন মুহম্মদ বদরুল

 প্রাক্তন ব্যবস্থাপক, পদ্মা অয়েল কোম্পানী লিমিটেড।

No comments

Theme images by merrymoonmary. Powered by Blogger.